খেলতে খেলতে পড়া... পড়তে পড়তে খেলা...
ভুমিকা - হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে খেলার ছলে শিশুদের গণিত শিক্ষার বুনিয়াদি ধাপগুলি শেখানো সম্ভব তার ভালো নমুনা আছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য নির্মিত গণিত বইগুলিতে । ২০১৩ সাল থেকে বইগুলোর ব্যবহার শুরু হলেও পদ্ধতিগুলো এখনও জনপ্রিয় হয়নি।
যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ থেকে শুরু করে ভগ্নাংশ, লসাগু, গসাগু, ক্ষেত্রফল থেকে শুরু করে বীজগাণিতিক নানা বিষয় হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে সামান্য নুড়ি পাথর, কাগজ কাঠি, কার্ড , ইত্যাদি শেখা যায় তার উদাহরণ আছে বইগুলিতে । দুটি সংখ্যার লসাগুকে যে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়, এবং তা কেবলমাত্র কিছু কাগজ ব্যবহার করেই করতে পারা যায় তার উদাহরণ আছে চতুর্থ পঞ্চম ষষ্ঠ শ্রেণীর বইএ । এই সব কিছু নিয়ে বাঁকুড়া জেলার রাধানগর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়েরএর শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায়, বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে গভীরভাবে কিছু কাজ করে চলেছেন ।
এই বিদ্যালয় সফলভাবে কয়েক বছর ধরে অঙ্ক মেলার আয়জন করেছে এবং ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে তার প্রভাব দেখা গেছে । এই সমস্ত বিষয় জেনে এবং সরজমিনে খতিয়ে দেখে |
বাঁকুড়া জেলা ব্যাপী নানা স্কুলে এই শিখন পদ্ধতিমালা ছড়িয়ে দিতে সমগ্র শিক্ষা মিশন বাঁকুড়া, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক ( মাধ্যমিক ) এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য সংস্থা মিলে একটা পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণ করেন।
পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়,
১) প্রথম থেকে নবম শ্রেণীর বইতে বুনিয়াদি গণিত শিক্ষার যে সমস্ত বিষয়গুলি আছে তা থেকে কতকগুলি বিষয় বেছে নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
২) সেই লক্ষ্যে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পাঠ্য বই হতে গণিতে উপর মোট ১৮ টি একক ও ৩০ এর বেশি উপ একক নির্বাচন করা হয় । যার প্রতিটিই সক্রিয়তা ভিত্তিক ।
৩) পাঠ্য বইয়ে ঠিক যেভাবে সামান্য উপকরণ সহযোগে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ লসাগু গসাগু ভগ্নাংশ থেকে শুরু করে বীজগাণিতিক সূত্র (a+b)3 হাতে কলমে, নিজে করে শেখার কথা আছে , সেভাবেই তার চর্চা হবে , এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ।
৪) কাগজ, কাঁচি, কার্ড, কাঁকর, গ্রাফ পেপার সহ নানান LTM ব্যবহার ও তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
Workshop সম্পাদন
এই পাইলট প্রজেক্টের পরিকল্পনা মতো - গত ২৫ ২৬ মার্চ ২০২৫ বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া সদর মহকুমার প্রায় সমস্ত সার্কেলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৫৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে একটি দুই দিনব্যাপী ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয় DIET , 2nd Campus , আয়লাকান্দি তে।
এখানে উপস্থিত ছিলেন বাঁকুড়া সমগ্র শিক্ষা মিশনের ডিসট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক , বাঁকুড়া জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ , DIET , 2nd Campus এর টিচার ইন চার্জ সহ অন্যান্য আধিকারিক বৃন্দ। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিলেবাস কমিটির প্রাক্তন সদস্য, হুগলির রাজা রামমোহন রায় মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও শিশু শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণামূলক কাজ করতে থাকা ডঃ দেবব্রত মজুমদার, রাধানগর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌম্য সেনগুপ্ত , সোমেন ব্যানার্জি, মানিকলাল সিংহ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রেখা ঝারিমুন্যা এবং নলপুকুর ফ্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভাস্কর রায়। প্রশিক্ষণে লারনিং টিচিং মেটিরিয়াল নির্মাণে সহযোগিতা করে জীবন শিক্ষা পরিষদ ।
কর্মশালা শুরু হয় একটি আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে। প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে তুলে দেওয়া হয় আত্মসমীক্ষা পত্র। ওঁরা এই সমীক্ষা পত্রের মাধ্যমে বুঝে নেন যে হাতে-কলমে শিক্ষার পদ্ধতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দুইদিনব্যাপী চলা এই প্রশিক্ষণ শিবিরে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে যে যে বিষয়গুলি শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়ে আলোচিত হয় তা নিম্নরূপ
প্রথম দিন যে যে বিষয়ে আলোচিত হয়
৭)প্রধান স্কেল এবং স্লাইড স্কেল এর সাহায্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যার যোগ বিয়োগ
৮) ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যা ধারণা এবং যোগ ও গুণ কীভাবে হাতে কলমে করা যায় ঃ-
৯) ভাস্কর স্যার এর হাতে কলমে বীজগাণিতিক সূত্রাবলী প্রয়োগ ঃ-
১০) ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যার গুণ (বাস্তব ধারণা )
১১) হাতে কলমে বৃত্তের পরিধি ও বাসের আনুপাত তথা কি এবং তার মান বোঝা এবং বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়
১২) কে কত গুলো হাতে কলমে প্রয়োগ করতে পারবে ঃ-
১৩) DPO মহাষয়ের বক্তব্য এবং বিভিন্ন জনের মতামত এবং পরিকল্পনা গ্রহনঃ-
সংবাদ শিরোনামে
এই ওয়ার্কশপের খবর আনন্দবাজার পত্রিকায় এবং কলকাতা টিভিতে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়।
কী পরিকল্পনা গৃহীত হয় ?
এই ওয়ার্কশপের শেষে শিক্ষক শিক্ষিকারা এই সমস্ত বিষয়গুলি নিজেদের স্কুলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যা নিম্নরূপ।
১) ওনারা ক্লাসরুমে এইভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের অঙ্ক শেখাবেন । ইতিমধ্যে ওনারা সেই কাজ শুরু করেছেন ।
২) প্রশিক্ষণ নেওয়া শিক্ষক শিক্ষিকারা কয়েকটি দল করে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করবেন।
ট্রেনিং এর শেষে কি করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা ? “আর পাঁচটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম এর মত এলাম ট্রেনিং নিলাম এবং চলে গেলাম এমনটা - এই ট্রেনিং ছিল না” বলে দাবি শিক্ষক শিক্ষিকাদের । workshop এর শেষে ওনাদের জন্য বানানো গুগল ফর্মে ওনারা এই ট্রেনিংয়ের ফিডব্যাক বিস্তারিত আকারে দেন।
ছবিতে , খেলার ছলে ভাগ শিখছে ছাত্র ছাত্রীরা । ওনারা এই ট্রেনিং থেকে শেখা বিষয়গুলি রীতিমতো স্কুলে প্রয়োগ করছেন এবং তার ফিডব্যাক দিচ্ছেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। আগামী দিনে এই ফিডব্যাক গুগল ফর্মে সকলে আপলোড করবেন।
কেমন লাগছে ছাত্র-ছাত্রীদের ? এভাবে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ এমনকি বীজগণিতের নানা বিষয় শিখে ছাত্রছাত্রীরা খুব খুশি। কয়েকটি বিদ্যালয়ের থেকে পাওয়া গেছে ছাত্রছাত্রীদের মতামত।
অভিভাবকদের মতামত - স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা হাতে-কলমে অংক বিজ্ঞান শেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের । বাড়িতেও বাবা-মা দেখছে ছেলেমেয়েরা কাঠি কাঁকর কার্ড দিয়ে অংক করছে। এই ঘটনাটি অভিভাবকরাও খুবই খুশি। নিজের সন্তানের কাছে শেখা অর্থবহ হয়ে উঠছে , এটা ওনাদের কাছে একটা বড় ভালোলাগার জিনিস হয়ে উঠেছে ।
প্রাপ্তি - এই ওয়ার্কশপের ফলে যে যে লাভ তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া গেছে
১) বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বইগুলোতে সরকারি অঙ্ক বইগুলোতে যে বিশ্বমানের পদ্ধতিমালা আছে এবং সেই পদ্ধতিমালা গুলো যে সামান্য উপকরণ প্রয়োগ করে সহজে ক্লাসরুমেই ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো সম্ভব তা হাতে-কলমে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরা যাচাই করে বুঝতে পারলেন।
২) এই কর্মশালার ফলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলে হাতে-কলমে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অংকের নানা বিষয় তুলে ধরছেন। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা কে ভালবাসতে শিখছে ফলে তারা আরো বেশি বেশি হয়ে উঠবে।
৩) বইগুলি সম্পর্কে এবং বইগুলির শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে সমাজে এমনকি শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যেও যে নেতিবাচক মনোভাব আছে তা দূর করা সম্ভব হবে।
সুদূরপ্রসারী ফলাফল
১) গতানুগতিক পদ্ধতিতে অঙ্ক নয়, বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর যুগে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রিটিক্যাল ও লজিক্যাল থিংকিং এর ক্ষমতা ঠিক করতে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিখনের প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণ করতে এই ওয়ার্কশপ আগামী দিনে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনবে।