খেলতে খেলতে পড়া... পড়তে পড়তে খেলা...
অঙ্ক ও বিজ্ঞান কে ছুঁয়ে দেখার, আনন্দঘন দুটো দিনের ইতিবৃত্ত !
এটা আমাদের কাছে ছিল এক অন্যরকমের চ্যালেঞ্জ। বাঁকুড়া জেলার প্রাক্তন ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার ও বর্তমান বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর মাননীয় Samarendra Roy মহাশয়ের কাছে যখন প্রথম প্রস্তাব পাই অঙ্ক - বিজ্ঞান - জীবনদায়ী কৌশল ও মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে আয়োজিত STEM Summer Camp এর প্রথম তিনটি বিষয় পরিচালনা করার তখন থেকেই মনের মধ্যে ছিল প্রশ্ন - ভালো লাগবে তো ওদের ? এই বিপুল আয়োজনের মান রাখা সম্ভব হবে তো ? কারণ সেখানে থাকবে নানা বিদ্যালয়ের নানা মিডিয়ামের তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রী ! আবার সাথে থাকবেন তাঁদের শিক্ষক শিক্ষিকা রা ! এবং সেটা পরপর দুই দিন !
কিন্তু তারপর যখন দেখা যায় , দৈর্ঘ্যের , ক্ষেত্রফলের ও আয়তনের নানা এককের নানা খুঁটিনাটি তথা, লিটার বা মিলিলিটারের "মিলি" কথার অর্থ হাতেকলমে বুঝে নিয়ে তার বাস্তব প্রয়োগ-অনুশীলনে নিজেরাই বানিয়ে ফেলে আস্ত একটা মেসারিং সিলিন্ডার ( মাপনী চোং ) ও তার সূক্ষ্ম মাপের হিসেব করতে করতে এবং ঐ যন্ত্রকেই রেইন গজ ( বৃষ্টি মাপক যন্ত্র ) বানাতে স্কেলের কী পরিবর্তন হয় বুঝতে বুঝতে , দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি তাদের কাছে আরেকটু পরে এলে ভালো হতো বলে মনে হয় , তখন কপালের ঘামের লবণ মনের মধ্যে এক অনাবিল লাবণ্য অনুভূতি আনে বৈকী !
হ্যাঁ, এমনই এক আনন্দ আয়োজনে গত ২৯-৩০ মার্চ , বাঁকুড়া থেকে ১৫০ কিমি দূরে হুগলীর ডুমুরডহ র একলব্য মডেল স্কুলে জীবন শিক্ষা পরিষদ এর পক্ষ থেকে Bhaskar আমি ও আমার দুই ছাত্র রাজু , শুভজিৎ উপস্থিত ছিলাম ।
মহাকাশ বিজ্ঞানের আলোচনা নিয়ে হাজির ছিলেন বিজ্ঞান মঞ্চের বন্ধুরা ।
আমরা ভালো করেই দেখতে পাই কী , লজিক ব্যাপারটাই আজ অনুপস্থিত আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে । আবার কোনোও কিছুকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার দক্ষতা তৈরী করতে অঙ্ক বিষয়টার জুড়ি মেলা ভার।
শিশু যদি সঠিক পদ্ধতিতে , হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে অঙ্ক শেখে তাহলে অঙ্ক তার কাছে হয়ে ওঠে মূর্ত ! পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় শেখার দক্ষতাও বাড়িয়ে দেয় এই অঙ্ক !
কিন্তু তাকে আমরা ভোঁতা করে ফেলেছি ভুল ভাল প্রয়োগে । একটা ছোট্ট উদাহরণ - শিশুকে ১-৯ সংখ্যা চেনাই , "একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ" নামের একটি ভুল ছড়া দিয়ে । কেন ভুল - সে এক বিস্তারিত আলোচনার বিষয় । (শুধু ভেবে বলুন তো , এই যে বলি "দুয়ে পক্ষ"- তো এই মুহূর্তে কোন্ পক্ষ চলছে ? )
তার বদলে , "শেখার সাথী" ড. দেবব্রত মজুমদার মহাশয়ের কাছে শেখা সংখ্যা চেনার মজার ছড়া " আকাশে ঐ একটা চাঁদ " দিয়ে শুরু হয় ওয়ার্ক শপ ! ছোটোরাই বুঝে নেয় তারা বড়ো হয়ে আর ভুল পদ্ধতিতে ছোটো কাউকে সংখ্যা চেনাবে না ।
তারপর আসে বাইনারী ও ডেসিমাল সিস্টেমের তুলনা যা থেকে বুঝে নেওয়া কেন দশ লিখতে আমরা ১ ও ০ এই দুই ছবি ব্যাবহার করি ? যেখানে কেবলমাত্র 0 ও 1 কে চেনা কম্পিউটার দশ বলতে বোঝে 1-0-1-0 , এই লজিক বুঝে নিয়ে ,ডেসিম্যাল সিস্টেমের সাথে নতুন করে পরিচয় হওয়ার পরই, একের পর এক চলে ভগ্নাংশ বুঝে নিয়ে ১.২৩৪ এর .২,.০৩ বা .০০৪ এর বাস্তব অস্তিত্ব বুঝে নিয়ে মিলি মিটার, বা মিলি গ্রাম এর "মিলি" কথার অর্থ বুঝে নিয়ে দৈর্ঘ্যের একক গুলিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চেনা।
কেন দুটি দৈর্ঘ্য গুন করলে একটি ক্ষেত্রফল পাওয়া যায় , চোখের সামনে ঘটতে দেখে চিনে নেওয়া ক্ষেত্রফলের একক এবং সেই সাথে বুঝে নেওয়া (a +b)^2 সূত্রে a^2 +2ab + b^2 কীভাবে আসে ।
( খেয়াল করে দেখুন পাঠক বৃন্দ, হাতেকলমে শিখলেই মানুষ বুঝে যাবে এখানে কিন্তু কোনোও "একস্ট্রা টু এ বি" আসে না ! )
এরপর একে একে বুঝে নেওয়া আয়তনের গল্প ! আয়তনের নানা একক কে ছায়া ছবির মতো দেখতে পাওয়া থেকে শুরু করে সেগুলি নিজে হাতেকলমে প্রয়োগ করা !
আর সব কিছুই ছিল কাজের মাধ্যমে ।
ধারেপাশের নানা শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বা ভাবনা চিন্তা করা মানুষের সাথে কথা বার্তা আদান প্রদানে এটা স্পষ্ট - আমাদের অনেকের ধারণা আছে , হাতেকলমে অঙ্ক শেখার দরকারই বা কী ? বেশ তো আমরাও "শিখে" গেছি, কিন্তু সেই শেখা কী আমাদের কাছে অর্থ বহন করে ? দুঃখের হলেও এটাই সত্যি, করে না ! যাঁরা বা, গুটিকয় আমরা সেটা অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছি, তাঁদের আবার বেশিরভাগজন মনে করেন, ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ঠিক আছে , কিন্তু হাই স্কুলে আর ওসবের গল্প নেই ।
তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ, ষষ্ঠ সপ্তম অষ্টম নবম শ্রেণীর অঙ্ক বই গুলি উলটে পালটে দেখুন ।
লসাগু গসাগু ক্ষেত্রফলের পাশাপাশি বীজগণিতের বহু বিষয়, সূত্রাবলী সুন্দর সুন্দর কাজের মাধ্যমে শেখার কথা আছে বইগুলোতে । এবং তা সামান্য কিছু উপকরণ ব্যবহার করে!
এমনকি , অষ্টম শ্রেণীর ( a+b)^3 ( a Plus b whole cube ) এর সূত্রও ছুঁয়ে দেখা যায়, 3a^2b এর মধ্যে যে তিনটি a^2b আছে , এমনই দুর্দান্ত কাজের হদিশ আছে বই গুলোতে !
এই প্রসঙ্গে আমার একটি অনুভূতির কথা বলি, অনেকদিন ধরেই আমি Alokesh দাদা, আমরা ভাবছিলাম ( a+b)^3 কীভাবে হাতে ছুঁয়ে দেখানো যায়? কাঠের মডেল তৈরীর কথা ভাবছিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ মেয়ে ও তার বন্ধুদের শেখানোর জন্য, ১৫ বছর আগে আমার বাবার আনা একটি kit কে ব্যাবহার করে যখন এই মডেল বানিয়ে ফেলি ,এক অনাবিল আনন্দ পাই !
আপনারা চাইলে দেখাতে পারি তার নমুনা !
আবার আসি অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে । বেশ ভালো রকম ভাবেই পড়ে যাওয়া গরমের মধ্যেই একলব্য মডেল স্কুল কর্তৃপক্ষের অনন্য ও নিখুঁত আয়োজনে এই ওয়ার্কশপে এইভাবেই ছাত্র ছাত্রীরা দুই দিন ধরে হাতেকলমে শেখে নিল অঙ্কের নানা বিষয় , নানা রাশির, নানা এককের মূর্ত রূপ এবং বাস্তব জীবনে তার নানা প্রয়োগের আনন্দ কথা ! আর অবশ্যই সাথে ছিল দ্রিমি দ্রিমি মাদলের তালে গান , ব্রতচারী ছড়া নাচ। ছিল মানব শরীরের ভেতর ঘুরে বেড়ানো এবং সব শেষে ম্যানীকিন সহযোগে হৃদ শ্বাস পুনরুজ্জীবন বুঝে নেওয়া। যা সুদূর আমেরিকা থেকে আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন প্রবাসী বিজ্ঞানী দিলীপ কুমার সোম।
আর প্রায় ৮৫ জনের শিশুদের এই হাতেকলমে শেখার উপকরণ গুলো কলকাতা থেকে আনা ও তাদের ব্যাবহার উপযোগী করে তোলা , ভাস্কর ছাড়া আর কার পক্ষেই বা সম্ভব হতো ? শেষ মুহূর্তে কী কী লাগবে বলায় স্কুল সেরে সেসব সামান্য অথচ অনন্য উপকরণগুলো কলকাতা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে পরদিন সঠিক সময়ে ওয়ার্কশপে আসা ও প্রথম দিনের রাত্রিবাস করার সময় আমার দুই ছাত্র রাজু ও শুভজিৎ এর সাথে সেগুলিকে কেটেকুটে নির্মাণ করার কাজটি করেছিলেন ভাতৃ প্রতীম ভাস্কর !
আর প্রথম দিনের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও বলাগড় বিজ্ঞান কেন্দ্রের যৌথ পরিবেশন টেলিস্কোপে সৌর কলঙ্ক দেখা , আকাশ পর্যবেক্ষণ ও মহাকাশ নিয়ে গল্প।
যাতে আমাদের ভূমিকা ছিল দর্শক ওরফে ছাত্রের।
Amit ভাইয়ের কাছে বাংলার মাস গুলির নামের সাথে চাঁদ ও তারার সম্পর্কের জেনে খুবই ভালো লেগেছে।
সব মিলিয়ে
একলব্য মডেল স্কুল, নৈহাটি কাত্যায়নী বালিকা বিদ্যালয়, সরগড়িয়া আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ পাবলিক স্কুল ,অক্সিলিয়াম কনভেন্ট স্কুল,ত্রিবেণী টিস্যুস বিদ্যাপীঠ , সুশীলা নিম্নবুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়,সেন্ট অ্যান্টোনিস প্রাইমারি স্কুল , একটা ভুল হয়েছে। আমারই। বলাগড় উচ্চ বিদ্যালয় , সোমড়া দুর্গা চরণ উচ্চ বিদ্যালয় ও জিরাট কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা ও অভিভাবক দের সাথে এক অনন্য সুন্দর মুহুর্ত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমাদের আগামী পথ চলার এক পাথেয় হয়ে রইল ।
শিশুদের কাছে শেখা কে আনন্দের, অর্থবহ করতে এই আয়োজনের সকল উদ্যোক্তাদের, আমাদের অন্ন জোগানো মানুষদের , আমাদের যত্ন নিয়ে দেখা শুনো করা সকল মানুষদের জন্য রইল একরাশ অভিবাদন !!
আসুন এই কাজে সকলে হাতে হাত রাখি! স্বপ্ন দেখি সেই দিনের , যেদিন প্রতিটা স্কুলে স্কুলে, ঘরে ঘরে এইভাবেই শেখার রেওয়াজ গড়ে উঠবে।
বাবা মা শিক্ষক শিক্ষিকা রা সকলে হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে শিখতে উৎসাহিত করবেন নিজের সন্তান সন্ততি ছাত্র ছাত্রীদের ! এই কাজের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবেন অন্তর থেকে !
তার পর যে প্রজন্ম তৈরি হবে যাদের চাইলেও আর ঠকিয়ে দেওয়া যাবে না, আর তারা কাউকে ঠকাবেও না !
আমাদের কাজের পরিচয় পেতে চাইলে
সৌম্য সেনগুপ্ত
সভাপতি, জীবন শিক্ষা পরিষদ